গত ২৪ মে ২০২২ বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান (স্পারসো)-তে রিমোট সেন্সিং ও জি আই এস প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলের ভৌগোলিক তথ্য ব্যবস্থা এবং সমুদ্রে মাছের বিচরণক্ষেত্র সনাক্তকরণ পদ্ধতি স্হাপন (১ম সংশোধিত)” শীর্ষক সমীক্ষা প্রকল্পের সমাপনান্তে জাতীয় পর্যায়ে অবহিতকরণের জন্য একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। ড. মুহম্মদ ইয়ামিন চৌধুরী, সচিব, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব গোলাম মোঃ হাসিবুল আলম সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন।
সেমিনারে স্বাগত ভাষণ প্রদান করেন স্পারসোর চেয়ারম্যান জনাব মোঃ জাফর উল্লাহ খান এবং টেকনিক্যাল প্রেজেন্টেশন প্রদান করেন এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ড. মোঃ আব্দুস ছালাম, চীফ সায়েন্টিফিক অফিসার, স্পারসো।
প্রকল্প পরিচালক ড. মোঃ আব্দুস ছালাম বলেন, বাংলাদেশের সমুদ্র সম্পদ নির্ভর সুনীল অর্থনীতির সাথে এটি প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গত ২০ আগষ্ট, ২০১৪ তারিখ “ব্লু ইকোনমি” সংক্রান্ত একটি যুগান্তকারী সভা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসারে সমুদ্রসম্পদ আহরণ ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২৭ এপ্রিল, ২০১৬ তারিখ পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা বিভাগ ‘‘বাংলাদেশের সমুদ্রসম্পদ আহরণ ও সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক কর্মপরিকল্পনার সমন্বিত প্রতিবেদন” শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রণালয়/বিভাগ/ সংস্থাসমূহের কার্যক্রম ও দায়িত্ব বর্ণনা করা হয়। উল্লিখিত সিদ্ধান্ত, কার্যক্রম ও প্রদত্ত দায়িত্বের আলোকে স্পারসো এই সমীক্ষা প্রকল্প প্রস্তাব প্রণয়ন করেছে।
রিমোট সেন্সিং ও জি আই এস প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার ভৌগোলিক তথ্যব্যবস্থা ও সমুদ্র এলাকায় মাছের বিচরণক্ষেত্র সনাক্তকরণ পদ্ধতি স্থাপন এবং নিয়মিতভাবে অংশীজনদের নিকট তথ্য সরবরাহ এই প্রকল্পের টেকসই স্থায়িত্বের পরিচয় বহন করে।
বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় বসবাসরত বিপুল জনগোষ্ঠী দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে। প্রায় প্রতি বছর সংঘটিত ঘূর্ণিঝড়, নদী ও উপকূলীয় এলাকার ভাঙ্গন, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা এবং লবণাক্ততা উপকূলীয় এলাকায় বসবাসরত জনগণের অর্থনৈতিক সমস্যাকে আরো তীব্র করে। উপকূলভিত্তিক টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়টি তাই গুরত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় অবস্থিত চর এবং দ্বীপগুলির অর্থনৈতিক কর্মকান্ড গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় হলেও এদের বেশিরভাগেই উল্লেখযোগ্য কোনো অর্থনৈতিক কর্মকান্ড নাই। বর্তমান সরকারের নেতৃত্বে সমুদ্রসীমা অর্জনের পর সমুদ্রসম্পদ আহরণ ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দেশের উপকূলীয় চর/দ্বীপগুলির অর্থনৈতিক কর্মকান্ড একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় অবস্থিত চর/দ্বীপগুলির আয়তন ও আকার-আকৃতি, জোয়ার-ভাটায় প্রাপ্ত দশা, মাটির গুণাগুণ, ভূমির স্থায়িত্ব, আবহাওয়া, দুর্যোগ প্রবণতা ইত্যাদির বিভিন্নতার বিষয়টি মাথায় রেখে এই প্রকল্পের মাধ্যমে দূর অনুধাবন প্রযুক্তিতে প্রস্তুতকৃত ভিত্তিমূলক ও চলমান ভৌগোলিক উপাত্তসম্ভার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তাছাড়া, স্থাপিত এই ভৌগোলিক তথ্যব্যবস্থা সার্বিকভাবে উপকূলীয় এলাকার আকার-আকৃতিগত পরিবর্তনের উপর নিয়মিত নজরদারি ও এসব এলাকার উন্নয়ন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সক্ষম হবে।
এই প্রকল্পের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিল, দূর অনুধাবন প্রযুক্তির উপর ভিত্তি করে সমুদ্র এলাকায় মাছের বিচরণক্ষেত্র সনাক্তকরণ পদ্ধতিটি স্থাপন;
আমাদের দেশে মাছের মোট উৎপাদনের শতকরা ১৬ ভাগ (৬.৫৯ লাখ মেট্রিক টন) সামুদ্রিক মাছের অবদান। বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী ও প্রাজ্ঞ নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিমি.এলাকায় বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সমুদ্রে স্থায়ীত্বশীল মৎস্য আহরণের নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে। তাই টেকসই পদ্ধতিতে মৎস্য আহরণের বিষয়টি বর্তমান প্রেক্ষপটে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। টেকসই পদ্ধতিতে মৎস্য আহরণের প্রাথমিক বিষয় হচ্ছে সমুদ্রে মাছের পরিমাণ নির্ণয় এবং মাছের বিচরণক্ষেত্র চিহ্নিতকরণ। সমুদ্রে মাছের বিচরণক্ষেত্র চিহ্নিতকরণের মাধ্যমে টেকসই পদ্ধতিতে মৎস্য আহরণের স্থান নির্ধারণ এবং অপেক্ষকৃত কম খরচে মৎস্য আহরণ সম্ভব। এর ফলে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়।
ড. মুহম্মদ ইয়ামিন চৌধুরী, সচিব, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় উল্লেখ করেন, সমুদ্রে মাছের বিচরণক্ষেত্র সনাক্তকরণের জন্য দূর অনুধাবন প্রযুক্তির প্রয়োগ করে স্যাটেলাইট উপাত্ত কম্পিউটারে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে প্রতিদিন সমুদ্রে মাছের বিচরণক্ষেত্র চিহ্নিতকরণের করার যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তা সত্যি প্রশসংনীয় ও সময়োপযোগী। প্রকল্পের তথ্য-উপাত্তসমূহ ব্যবহার করে মাছের বিচরণক্ষেত্র সংক্রান্ত মানচিত্র ও তথ্য মৎস্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে উপকূলীয় এলাকার মৎস্যজীবীদের কাছে প্রতিদিন সরবরাহ করা হবে-যা পরিকল্পিত উপায়ে মৎস্য আহরণ ও সংরক্ষণ বিষয়ে টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা অর্জনে সহায়ক হবে। এছাড়া, স্পারসোর এই প্রকল্পটা আরো বিভিন্ন প্যারামিটার নিয়ে বৃহৎ পরিসরে গবেষণা কার্য পরিচালনার জন্য অনুরোধ জানান।
স্পারেসোর চেয়ারম্যান জনাব মোঃ জাফর উল্লাহ খান, তাঁর বক্তব্যে প্রকল্পের একটি লক্ষণীয় দিক তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ২০১৯ থেকে ২০২২ সালের জুন মাস পর্যন্ত চলমান এই প্রকল্পে ব্যয় ছিল ৩.৫ কোটি টাকা। এছাড়া, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সাথে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান (স্পারসো) প্রকল্প বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনী, বাংলাদেশ কোষ্ট গার্ড এবং মৎস্য অধিদপ্তরের প্রতিনিধির সাথে যোগাযোগ এবং আনুষ্ঠানিক সভার মাধ্যমে উল্লিখিত অংশীদারিত্বমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেছে; যা সময়, অর্থ সাশ্রয় ও আন্ত: প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়ের এক অনন্য মেল বন্ধন সৃষ্টি করেছে।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব গোলাম মোঃ হাসিবুল আলম বলেন, বাংলাদেশের সমুদ্রসম্পদ আহরণ ও সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনাসহ উপকূলের যাবতীয় অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে স্পারসোর বাস্তবায়িত এই প্রকল্পের ফলাফলসমূহ (তথ্য-উপাত্ত) নিয়মিতভাবে প্রতি ছয় মাস অন্তর অংশিজনদের সরবরাহের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত ‘‘ব্লু ইকোনমি” সংক্রান্ত কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করবে, যা জাতীয় অর্থনীতিকে আরো সমৃদ্ধ করবে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশের তালিকায় উন্নীত করার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।
সেমিনারে আরও উপস্থিত ছিলেন জনাব মুহম্মদ আবদুর রউফ হাওলাদার, পরিচালক, প্রতিরক্ষা সার্ভে, বাংলাদেশ জরিপ অধিদপ্তর, ড. মোঃ নিয়ামুল নাসের, অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জনাব মোঃ মাহমুদ আলী, সদস্য (গবেষণা), স্পারসো সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ।